এক এক করে ২৭ বছরে পা দিয়েছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরমধ্যে দীর্ঘ ৯ বছর নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যানের অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন। এ হিসাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অতিবাহিত সময়কে ৯ বছর করে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। এরমধ্যে খায়রুল হোসেনের মেয়াদে সব থেকে কম প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
১৯৯৩ সালে বিএসইসি গঠনের পর ২৭ বছরে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে ২৮৫ কোম্পানি। এরমধ্যে কমিশন গঠনের প্রথম ৯ বছরে তালিকাভুক্ত হয় ১০০ কোম্পানি। পরের ৯ বছরে তালিকাভুক্ত হয়েছে ৯৪টি। আর খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশনের শেষ ৯ বছরে তালিকাভুক্ত হয়েছে ৯১টি কোম্পানি।
২০১০ সালে মহাধসের পর তদন্ত কমিটির সুপারিশে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি পুনর্গঠন করে সরকার। এতে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান খায়রুল হোসেন। তার সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি চালানোর দায়িত্ব পান অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী, আরিফ খান ও মো. আমজাদ হোসেন। একপর্যায়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির নামও পালটে যায়। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) থেকে সংস্থাটির নাম বদলে হয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
ইতোমধ্যে পুনর্গঠিত বিএসইসি থেকে খায়রুল হোসেনের সঙ্গে নিয়োগ পাওয়া সব কমিশনারের চুক্তিভিক্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়েছে। খায়রুল হোসেনের মেয়াদও শেষের পথে। আগামী ১৪ মে তার নিয়োগ শেষ হবে।
খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশনের আইপিও অনুমোদন দেয়া নিয়ে অনেক সমালোচনাও হয়েছে। একপর্যায়ে আইপিও অনুমোদন দেয়া কিছুদিনের জন্য বন্ধও রাখা হয়। কিন্তু সেই কমিশনের মেয়াদেই সব থেকে কম আইপিও আসল। অথচ এ সময়ে দেশের অর্থনীতি বড় হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অর্থনীতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আইপিও বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটেছে তার উল্টো। এর কারণ হলো দেশের অর্থনীতির সঙ্গে শেয়ারবাজার এগোতে পারছে না। তারা বলছেন, এই সমস্যা কাটিয়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকের পরিবর্তে শেয়ারবাজারকে উৎস করার উচিত। কিন্তু গত ৯ বছরে তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে এবং অনেক বড় হয়েছে। কিন্তু দেশের শেয়ারবাজার সেভাবে এগোচ্ছে না। এই সমস্যা কাটিয়ে তুলতে শেয়ারবাজারের অংশগ্রহণ বাড়ানো দরকার। এক্ষেত্রে বেশি বেশি করে ভালো কোম্পানি শেয়ারবাজারে আনতে হবে। সুবিধা দিয়ে হলেও ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’
এদিকে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের মূলধন জিডিপির তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এমনকি পাকিস্তানের থেকেও পিছিয়ে বাংলাদেশ। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা রয়েছে। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে শেয়ারবাজারে বিভিন্ন কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাড়ানো দরকার হলেও ২০১৯ সালে তা আরও কমেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক সদস্য বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনও পুঁজির উৎস হিসেবে উদ্যোক্তারা শেয়ারবাজারের চেয়ে ব্যাংক ঋণের ওপর বেশি নির্ভরশীল। সামগ্রিকভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহের চেয়ে অনেক বেশি। গত কয়েক বছরে শেয়ারবাজারের অবস্থা আগের তুলনায় শক্তিশালী হলেও এখান থেকে মৌলিক খাতে মূলধন স্থানান্তরের প্রবণতা অনেক কম।’
খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন বিএসইসির দায়িত্ব নেয়ার আগে বা ৯ বছর আগে জিডিপির তুলনায় শেয়ারবাজারের আকার ছিল ৫০ দশমিক ৭০ শতাংশ। যা এখন ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশে নেমে এসেছে। এর অন্যতম কারণ দেশের অর্থনীতি যে হারে এগোচ্ছে, সে হারে শেয়ারবাজারে কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। এছাড়া ২০১৯ সালে শেয়ারবাজারের মন্দার কারণেও অনুপাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
জিডিপিতে শেয়ারবাজার পিছিয়ে পড়ার আরেকটি অন্যতম কারণ হিসেবে রয়েছে আর্থিক খাতের মন্দাবস্থা ও শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়া। একসময় ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির শেয়ার চাঙ্গা থাকলেও এখন তলানিতে। অথচ শেয়ারবাজারে এই খাতের অংশগ্রহণ বেশি। যা চাঙ্গা মূহূর্তে জিডিপির তুলনায় শেয়ারবাজারের অনুপাত বেশি ছিল। কিন্তু ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির শেয়ারের তলানিতে নেমে আসায় অনুপাতও কমেছে।
এছাড়া ২০০৯-১০ সালে ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ ছিল বেশি। আর সেই সুযোগের থেকেও অনেক ব্যাংক বেশি বিনিয়োগ করে। আর এখন বিনিয়োগের সুযোগ প্রায় চার ভাগের এক ভাগে কমিয়ে আনার পরেও অনেক ব্যাংকের বিনিয়োগ ঘাটতি রয়েছে।